ব্রাজিলে ব্যবসা সম্প্রসারণ
মোঃ জয়নাল আব্দীন
প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট বাংলাদেশ (T&IB)
নির্বাহী পরিচালক, অনলাইন ট্রেনিং একাডেমি (OTA)
মহাসচিব, ব্রাজিল–বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (BBCCI)
লাতিন আমেরিকার সর্ববৃহৎ অর্থনীতি ব্রাজিল আজ বৈশ্বিক উদ্যোক্তা ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অন্যতম প্রধান গন্তব্য। প্রায় বিশ কোটির বেশি জনসংখ্যা, ক্রমবর্ধমান ভোক্তা বাজার, শক্তিশালী শিল্পভিত্তি এবং বিশাল আমদানি নির্ভরতার কারণে ব্রাজিল আন্তর্জাতিক ব্যবসার জন্য একটি কৌশলগত বাজার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যারা “how to do business in Brazil” বা “startup in Brazil” বিষয়ে তথ্য খুঁজছেন, তাদের জন্য ব্রাজিল শুধু একটি বড় বাজার নয়, বরং একটি দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্যিক সম্ভাবনার ক্ষেত্র।
বাংলাদেশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য ব্রাজিল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দেশটি টেক্সটাইল, গার্মেন্টস, লেদার গুডস, কৃষিপণ্য, প্রসেসড ফুড, আইটি সল্যুশন এবং লাইট ম্যানুফ্যাকচারিং পণ্যের বড় আমদানিকারক। তবে এই সুযোগ কাজে লাগাতে হলে ব্রাজিলের ব্যবসায়িক কাঠামো, আইনি প্রক্রিয়া, কর ব্যবস্থা এবং বাজার বাস্তবতা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরি।
ব্রাজিলে ব্যবসা শুরু করার প্রথম ধাপ হলো একটি উপযুক্ত আইনি কাঠামো নির্বাচন করা। বিদেশি উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে সাধারণত Sociedade Limitada বা LTDA কাঠামোটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়, যা বাংলাদেশের প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির সমতুল্য। এই কাঠামো উদ্যোক্তাকে সীমিত দায়বদ্ধতা দেয় এবং পরিচালনাগত নমনীয়তা নিশ্চিত করে। কোম্পানি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয় সংশ্লিষ্ট রাজ্যের Junta Comercial-এ নাম সংরক্ষণ ও নিবন্ধনের মাধ্যমে। এই ধাপ শেষ হলে Receita Federal থেকে CNPJ নামে জাতীয় কর শনাক্তকরণ নম্বর সংগ্রহ করতে হয়, যা ব্যাংক হিসাব খোলা, আমদানি-রপ্তানি, কর্মী নিয়োগ এবং কর পরিশোধের জন্য অপরিহার্য।
কোম্পানি নিবন্ধনের পাশাপাশি ব্রাজিলে বৈধভাবে ব্যবসা পরিচালনার জন্য একাধিক প্রশাসনিক অনুমোদন গ্রহণ করতে হয়। প্রতিটি ব্যবসাকে অবশ্যই পৌরসভা থেকে Alvará de Funcionamento নামে অপারেটিং লাইসেন্স নিতে হয়, যা প্রমাণ করে যে ব্যবসাটি নির্ধারিত ঠিকানায় আইনানুগভাবে পরিচালিত হচ্ছে। যেসব প্রতিষ্ঠান পণ্য উৎপাদন বা বিক্রয়ের সঙ্গে যুক্ত, তাদের রাজ্য কর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে Inscrição Estadual নিতে হয়, যা ICMS কর ব্যবস্থার আওতায় পড়ে। সেবাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের জন্য পৌরসভা পর্যায়ে ISS কর নিবন্ধন প্রয়োজন হয়। খাদ্য, ওষুধ, চিকিৎসা সামগ্রী বা কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিশেষ অনুমোদন নিতে হয়, যা সময় ও প্রস্তুতির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সাধারণত ষাট থেকে নব্বই দিনের মধ্যে সম্পন্ন হয়, যদি কাগজপত্র সঠিকভাবে প্রস্তুত থাকে। নিবন্ধন ও সরকারি ফি রাজ্যভেদে ভিন্ন হলেও এটি সাধারণত কয়েক হাজার ব্রাজিলিয়ান রিয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। বিদেশি উদ্যোক্তাদের জন্য অনুবাদ, নোটারি ও কনস্যুলার প্রক্রিয়ার কারণে প্রাথমিক ব্যয় কিছুটা বেশি হতে পারে, যা ব্যবসা পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

ব্রাজিলে ব্যবসা করতে গেলে কর ব্যবস্থাই সবচেয়ে বড় বাস্তব চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে আসে। দেশটির কর কাঠামো বহুস্তর বিশিষ্ট এবং তুলনামূলকভাবে উচ্চহারের। কর্পোরেট আয়করের হার প্রায় চৌত্রিশ শতাংশ, যা অনেক উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় বেশি। এর পাশাপাশি পণ্য ও সেবার ওপর একাধিক পরোক্ষ কর আরোপিত হয়, যেমন ICMS, IPI, ISS এবং PIS/COFINS। এই করগুলো ফেডারেল, রাজ্য ও পৌরসভা পর্যায়ে আরোপিত হওয়ায় কর ব্যবস্থাপনা জটিল হয়ে ওঠে। তবে ছোট ও মাঝারি ব্যবসার জন্য Simples Nacional নামে একটি বিশেষ কর কাঠামো রয়েছে, যা নির্দিষ্ট আয়ের সীমার মধ্যে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তুলনামূলক সহজ ও কম কর ব্যবস্থার সুবিধা দেয়। সঠিক কর কাঠামো নির্বাচন না করলে ব্যবসার লাভজনকতা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হতে পারে।
আমদানি ও রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ব্রাজিলে SISCOMEX নামক কেন্দ্রীয় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা হয়। রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রক্রিয়া তুলনামূলক সহজ এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে রপ্তানি পণ্যের ওপর কর আরোপ করা হয় না। বিপরীতে আমদানির ক্ষেত্রে কর ও শুল্কের পরিমাণ অনেক বেশি। অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, ভ্যাট ও অন্যান্য কর মিলিয়ে মোট করভার পণ্যের মূল্যের প্রায় অর্ধেক পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এই কারণে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের জন্য স্থানীয় ব্রাজিলিয়ান আমদানিকারক বা ডিস্ট্রিবিউটরের সঙ্গে অংশীদারিত্ব একটি কার্যকর বাজার প্রবেশ কৌশল হিসেবে বিবেচিত হয়।
ব্রাজিলের অভ্যন্তরীণ বাজার অত্যন্ত আঞ্চলিকভিত্তিক। São Paulo দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী এবং সবচেয়ে বড় ভোক্তা ও শিল্প বাজার। Rio de Janeiro, Minas Gerais, Paraná এবং Santa Catarina রাজ্যগুলোও গুরুত্বপূর্ণ শিল্প ও বাণিজ্য কেন্দ্র। পাইকারি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে CEASA ও CEAGESP-এর মতো কেন্দ্রগুলো কৃষিপণ্য ও খাদ্যপণ্যের প্রধান সরবরাহকেন্দ্র হিসেবে কাজ করে, আর São Paulo শহরের Brás, Bom Retiro ও Rua 25 de Março এলাকা টেক্সটাইল, গার্মেন্টস ও আমদানিকৃত পণ্যের জন্য সুপরিচিত।
বিতরণ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে ব্রাজিলে একাধিক কার্যকর মডেল বিদ্যমান। বড় রিটেইল চেইন, স্থানীয় ডিস্ট্রিবিউটর, ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম এবং ফ্র্যাঞ্চাইজিং সবকিছুই বাজারে প্রবেশের সম্ভাব্য পথ। তবে দেশের আকার ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের কারণে একক বিতরণ কৌশল সব অঞ্চলে কার্যকর হয় না। তাই অঞ্চলভিত্তিক বাজার বিশ্লেষণ ও স্থানীয় অংশীদার নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যেসব উদ্যোক্তা ব্রাজিলে শারীরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চান, তাদের জন্য একটি ছোট শোরুম স্থাপনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। São Paulo-এর মাঝারি বাণিজ্যিক এলাকায় পাঁচশ বর্গফুটের একটি শোরুম স্থাপন করতে ভাড়া, জামানত, অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা, লাইসেন্স ও প্রাথমিক পণ্য মজুত মিলিয়ে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ প্রয়োজন হয়। বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, এমন একটি উদ্যোগ শুরু করতে সাধারণত দশ হাজার মার্কিন ডলার বা তার বেশি মূলধন দরকার হয়।

সবশেষে বলা যায়, ব্রাজিলে ব্যবসা সম্প্রসারণ বাংলাদেশি এসএমইদের জন্য একটি উচ্চ সম্ভাবনাময় কিন্তু প্রস্তুতিনির্ভর সিদ্ধান্ত। সঠিক আইনি কাঠামো নির্বাচন, কর ব্যবস্থার বাস্তব জ্ঞান, নির্ভরযোগ্য স্থানীয় অংশীদার এবং ধাপে ধাপে বাজারে প্রবেশ কৌশল গ্রহণ করলে ব্রাজিলের বিশাল অর্থনীতিতে টেকসই ও লাভজনক ব্যবসা গড়ে তোলা সম্ভব। যারা দীর্ঘমেয়াদে আন্তর্জাতিক বাজারে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে চান, তাদের জন্য ব্রাজিল নিঃসন্দেহে একটি কৌশলগত ও ভবিষ্যৎমুখী বাজার।

