বাংলাদেশে বিনিয়োগ: বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য সুযোগ ও নির্দেশিকা

বাংলাদেশে বিনিয়োগ: বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য সুযোগ ও নির্দেশিকা

 

মোঃ জয়নাল আব্দীন
প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট বাংলাদেশ (T&IB)
নির্বাহী পরিচালক, অনলাইন ট্রেনিং একাডেমি (OTA)
মহাসচিব, ব্রাজিল–বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (BBCCI)

 

বাংলাদেশ গত দুই দশকে একটি সংগ্রামরত অর্থনীতি থেকে এশিয়ার অন্যতম দ্রুত বৃদ্ধি অর্জনকারী বাজারে রূপান্তরিত হয়েছে[1]। ক্রমাগত ৬-৭% হারে জিডিপি বৃদ্ধি, ১৭০ মিলিয়নেরও বেশি ভোক্তাবাজার এবং স্থিতিশীল macros অর্থনৈতিক নীতি দেশটিকে বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের কাছে আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত করেছে[2]। দেশের দৃশ্যমান অবকাঠামোগত উন্নয়ন সড়ক, সেতু, বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রো রেল ও স্মার্ট সিটির বিকাশ এবং স্বল্প শ্রমব্যয় ও অনুকূল ব্যবসায় পরিবেশ বাংলাদেশকে বিনিয়োগের মানচিত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে[3]। গবেষণা অনুযায়ী ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতি ট্রিলিয়ন ডলারে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে[4]। সরকারের বিনিয়োগবান্ধব নীতি ও সংস্কার, কর প্রণোদনা এবং তরুণ প্রযুক্তিমুখী জনগোষ্ঠীর উত্থান এ সম্ভাবনাকে এগিয়ে নিচ্ছে। বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (FDI) ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে এবং ২০২4 সালে নেট FDI প্রবাহ ৩.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে[5], যা বিশ্বমন্দার মাঝেও উর্ধ্বমুখী প্রবণতা প্রদর্শন করছে। এই অনুকূল প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুযোগ ও দিকনির্দেশনা সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা নেওয়া বিনিয়োগকারীদের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

 

শীর্ষ ১০ লাভজনক খাত ও শিল্পসমূহ

বাংলাদেশের বৈচিত্র্যময় অর্থনীতিতে বহুবিধ খাতে বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। নিম্নে দেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ও লাভজনক ১০টি খাত উপস্থাপন করা হলো, যেগুলোতে দেশীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা উল্লেখযোগ্য সুবিধা ও প্রবৃদ্ধি পেতে পারেন:

  1. বস্ত্র ও তৈরি পোশাক শিল্প (Textiles & RMG): পোশাক শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের শীর্ষ খাত। বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে[6]। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশটি ৪৬.৯৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে, যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ১০.২৭% বেশি[6]। প্রতিযোগিতামূলক শ্রমব্যয়, দক্ষ কর্মশক্তি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ প্রধান বাজারগুলোতে শুল্কমুক্ত সুবিধার ফলে এই খাতটি আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে আকর্ষণীয়। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর শুল্ক সুবিধা হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও বাংলাদেশ পরিবেশবান্ধব উৎপাদন, উচ্চ মূল্যের পণ্য (যেমন ম্যান-মেইড ফাইবার ভিত্তিক পোশাক) ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে খাতটির প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখতে কাজ করছে। সরকারের নীতি সহায়তা ও সবুজ শিল্পায়নের উদ্যোগ এ খাতে বিনিয়োগের ঝুঁকি মোকাবিলায় সহায়ক হচ্ছে।
  2. তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ও আইটি-সেবা খাত (ICT & ITES): ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের ফলে তথ্যপ্রযুক্তি খাতটি দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। দেশে বর্তমানে ১২.৫ কোটি মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী ও ১০ কোটি’রও বেশি ইন্টারনেট গ্রাহক রয়েছে[7], যা ডিজিটাল সেবা ও অনলাইন বাণিজ্যের জন্য বিশাল বাজার সৃষ্টি করেছে। আইটি আউটসোর্সিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট এবং বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (BPO) খাতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতা করছে। মোবাইল ব্যাংকিং, ই-কমার্স, ফিনটেক, এডটেক, হেলথটেক স্টার্টআপগুলোতে বিদেশি বিনিয়োগ ক্রমবর্ধমান। সরকারের ভিশন ২০২১ ও ভিশন ২০৪১ উদ্যোগসমূহ এবং হাই-টেক পার্ক স্থাপন, আইটি খাতে কর অব্যাহতি ও নগদ প্রণোদনার ফলে এই খাতে বিনিয়োগের পরিবেশ অনুকূল হয়েছে[8][9]। তথ্যপ্রযুক্তি রপ্তানি ২০২৩ সালে প্রায় ১.৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে[8] এবং ভবিষ্যতে আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
  3. ফার্মাসিউটিক্যালস ও স্বাস্থ্যসেবা (Pharmaceuticals & Healthcare): বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দৃশ্যমান বৃদ্ধি অর্জন করেছে এবং দেশের জিডিপিতে প্রায় ১.৮৩% অবদান রাখছে[10]। দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলি অভ্যন্তরীণ চাহিদার ৯৮% পর্যন্ত ওষুধ উৎপাদন করতে সক্ষম[11], ফলে বাংলাদেশ অনেকটাই ওষুধে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ২০২২ সালে ওষুধ শিল্পের বাজারপ্রমাণিত আকার ছিল প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০২৫ সালের মধ্যে তা ৬ বিলিয়ন ডলার অতিক্রমের পূর্বাভাস রয়েছে[11]। গত পাঁচ বছরে এ খাতের বার্ষিক যৌগিক প্রবৃদ্ধির হার ১৫.৬% যা অত্যন্ত সন্তোষজনক[11]। বাংলাদেশ থেকে ১৫০টিরও বেশি ওষুধ কোম্পানি বিভিন্ন দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে, ২০২২ অর্থবছরে ১৮৮.৮ মিলিয়ন ডলারের ওষুধ ১৫৭টি দেশে রপ্তানি হয়েছে[12]। সরকার এ খাতে API (Active Pharmaceutical Ingredient) উৎপাদন বাড়াতে বিশেষ নীতি গ্রহণ করেছে এবং স্থানীয় API ও রিএজেন্ট উৎপাদনকারীদের জন্য কর অব্যাহতি, নগদ প্রণোদনা ও ভ্যাট ছাড়ের সুবিধা প্রদান করছে[13][14]। স্বাস্থ্যসেবার চাহিদাও দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে বাড়ছে, বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও মেডিকেল ডিভাইস উৎপাদনে বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে।
  4. কৃষি ও কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ (Agribusiness & Agro-processing): কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াকরণ খাতটি এক বিপুল সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। দেশের উর্বর ভূমি ও অনুকূল জলবায়ু বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের জন্য উপযোগী, যা কৃষিভিত্তিক শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ নিশ্চিত করে[15]। বাংলাদেশের মোট অর্থনীতিতে কৃষির ভূমিকা উল্লেখযোগ্য হলেও, আধুনিক প্রসেসিং অবকাঠামোর অভাবে এখনও অনেক মূল্যের সংযোজন সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের নগরায়ণ ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ছে এবং স্বাস্থ্যসম্মত পুষ্টিকর খাদ্যের চাহিদা তৈরি হয়েছে[16][17]। একদিকে চাষযোগ্য জমি ক্রমশ কমছে ও জলবায়ু পরিবর্তনের চাপ রয়েছে, অন্যদিকে খাদ্যপ্রস্তুত শিল্পে বিনিয়োগের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে[16]। বর্তমানে দেশে প্রায় ৯.১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের খাদ্যশস্য ও কৃষিপণ্য আমদানি করতে হয় ২০২১-২২ সালে[18], যা ইঙ্গিত দেয় যে স্থানীয় agro-processing খাতে বিনিয়োগ করে আমদানি বিকল্প উৎপাদন সম্ভব। সরকার রপ্তানিমুখী agro-processing উদ্যোগগুলোর জন্য কর অবকাশ, মুনাফা পুনর্বাট ও নগদ সহায়তা দিচ্ছে[19][20]। শস্য প্রক্রিয়াকরণ, দুগ্ধ ও মাংসজাত পণ্য, হিমায়িত ও প্রক্রিয়াজাত মাছ, ফলমূল প্রক্রিয়াকরণ ইত্যাদি উপখাতে বিনিয়োগকারীরা উল্লেখযোগ্য সুযোগ পাবেন।
  5. চামড়া ও পাদুকা শিল্প (Leather & Footwear): বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য শিল্প ঐতিহ্যবাহী এবং দীর্ঘদিন ধরে অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে আসছে। বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী চামড়া ও চামড়া পণ্যের বাজারের প্রায় ৩% শেয়ার ধারণ করে এবং বিশ্ব চামড়া বাজারের ১০% কাঁচামাল সরবরাহে অংশীদার[21][22]। ২০২০ সালে দেশের অভ্যন্তরীণ জুতা বাজারের আকার প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার ছিল, এবং বছরে ৩৭৮ মিলিয়ন জোড়া জুতা উৎপাদিত হয়েছে[22]। বাংলাদেশে উৎপাদিত প্রায় ৮৫% চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়ে থাকে, যার বড় অংশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান এবং উত্তর আমেরিকার বাজারে যায়[23]। সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে চামড়া ও পাদুকা পণ্য রপ্তানি আয় বর্তমান ~১ বিলিয়ন ডলার থেকে বৃদ্ধি করে ১০-১২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানো[24]। এ লক্ষ্য অর্জনে সরকার ২০১৯ সালে জাতীয় চামড়া ও চামড়া পণ্য উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করেছে, যার আওতায় রাজশাহী, সাভার ও চট্টগ্রামে আধুনিক চামড়া শিল্প পার্ক স্থাপন করা হচ্ছে[25]। চামড়া শিল্পে বিনিয়োগকারীদের জন্য ৫-১০ বছরের কর ছাড়, যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক মুক্তি, রপ্তানি আয়ের উপর নগদ সহায়ক (১৫% নগদ প্রণোদনা এবং সাভার ট্যানারি থেকে সরবরাহকৃত চামড়ার জন্য অতিরিক্ত ৫%) প্রভৃতি সুবিধা রয়েছে[26][27]। এসব উদ্দীপনা ও বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের সুনাম বিবেচনায় চামড়া ও ফুটওয়্যার খাতে বিনিয়োগ লাভজনক হতে পারে।
  6. ইলেকট্রনিক্স ও হালকা প্রকৌশল (Electronics & Light Engineering): বাংলাদেশের উদীয়মান ইলেকট্রনিক্স খাত স্থানীয় বিশাল ভোক্তাবাজারের কারণে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলি ঘরোয়া ব্যবহার্য ইলেকট্রনিক পণ্য (যেমন টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার, মোবাইল ফোন ইত্যাদি) উৎপাদনে এগিয়ে আসছে। অনুমান করা হয় যে ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের ইলেকট্রনিক্স ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের বাজারের আকার ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করবে এবং ভোক্তা ইলেকট্রনিক্স বাজার ২০৩০ সালের মধ্যে ১০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে[28]। প্রায় ৩,০০০ প্রতিষ্ঠান এ খাতে যুক্ত এবং ১০ লক্ষের বেশি লোকের কর্মসংস্থান করছে[29]। সরকারের ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ উদ্যোগ ও বিভিন্ন উপকরণ আমদানিতে শুল্ক রেয়াতের ফলে স্থানীয় উত্পাদকরা বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন। কম্পিউটার ও মোবাইল ফোন অ্যাসেম্বলিং, ইলেকট্রিক গাড়ির যন্ত্রাংশ, এবং উপভোক্তা ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনে বিনিয়োগের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল অর্থনীতির জন্য হার্ডওয়্যার ও IoT ডিভাইসের বাজারও প্রসারিত হচ্ছে[30]। এই খাতে বিনিয়োগকারীরা কর অব্যাহতি, যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্কছাড় এবং রপ্তানিতে নগদ সহায়ক পাওয়ার সুযোগ পান, যা বিনিয়োগকে আরো লাভজনক করে তুলেছে।
  7. প্লাস্টিক ও প্যাকেজিং শিল্প (Plastics & Packaging): প্লাস্টিক শিল্প বাংলাদেশে একটি মূল উদীয়মান শিল্পখাত, যা অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও বিভিন্ন রপ্তানি খাতকে সহায়তা প্রদান করে চলেছে। দেশে প্রায় ৫,০০০টিরও বেশি প্লাস্টিক উৎপাদনকারী কারখানা রয়েছে, যেখানে প্রায় ১২ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে[31]। প্লাস্টিক পণ্যসমূহ দেশীয় বাজারের পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে এবং নির্মাণ, স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি, তৈরিপোশাকসহ বহু খাতের কাঁচামাল বা উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে[31]। বাংলাদেশ মূলত খাদ্য ও ওষুধ শিল্পের জন্য প্যাকেজিং সামগ্রী, গৃহস্থালী প্লাস্টিক পণ্য, পাইপ/টিউব, পোশাক শিল্পের হ্যাঙ্গার ও অ্যাকসেসরিজ, খেলনা, স্বাস্থ্য ও স্যানিটারি পণ্য ইত্যাদি উৎপাদন করছে[32]। ক্রমবর্ধমান ভোক্তাবাজার ও শিল্পায়নের কারণে প্লাস্টিক পণ্যের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ছে। সরকার পরিবেশবান্ধব প্লাস্টিক ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ ব্যবহারে গুরুত্ব দিচ্ছে, যা আধুনিক প্রযুক্তি সংবলিত বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব। পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পের বিকাশ এবং রপ্তানি সম্ভাবনাময় পণ্য উৎপাদনের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্লাস্টিক খাতে বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘমেয়াদে সুফল লাভ করতে পারেন।
  8. অবকাঠামো ও নির্মাণখাত (Infrastructure & Construction): বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে গত দশকে ব্যাপক বিনিয়োগ হয়েছে এবং এটি চলমান রয়েছে। রাজধানী ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল মহানগরীগুলোর একটি, যেখানে প্রতি বছর প্রায় ৬ লাখ নতুন অধিবাসী যুক্ত হচ্ছে – অর্থাৎ বছরে ১.২ লাখ নতুন পরিবারের বাসস্থান প্রয়োজন হচ্ছে[33]। পাশাপাশি, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী ট্যানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ইত্যাদির মতো একাধিক মেগা-প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে কিংবা পরিকল্পনাধীন রয়েছে। দেশের বিদ্যুৎ গ্রিড, সড়ক ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থা জনগণের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে প্রতিবছর আনুমানিক ৮-১০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা প্রয়োজন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে[33]। অবকাঠামো খাতে এ বিনিয়োগ প্রবাহ নির্মাণ শিল্প ও রিয়েল এস্টেট খাতকে গত পাঁচ বছরে যথাক্রমে ৮% এবং ৪% হারে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করেছে[34]। দ্রুত নগরায়ণ ও সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় নির্মাণ সামগ্রী (যেমন স্টিল ও সিমেন্ট) এর চাহিদা প্রচুর বেড়েছে[35]। এ প্রেক্ষাপটে, সড়ক-সেতু নির্মাণ, আবাসন উন্নয়ন, নগর অবকাঠামো, বন্দর ও পরিবহন অবকাঠামো উন্নয়ন, ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (PPP) মডেলের মাধ্যমে অবকাঠামো প্রকল্পে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সরকার উৎসাহ প্রদান করছে।
  9. বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত (Power & Energy): বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশের সাথে সাথে জ্বালানি ও বিদ্যুতের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বিগত বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেলেও গ্রিডের চাহিদা মেটাতে আরও বিনিয়োগের সুযোগ আছে। সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানি (যেমন সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি) উৎপাদনে জোর দিচ্ছে এবং বেসরকারি খাতে শক্তি উৎপাদনে অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করছে। ইতোমধ্যে স্বাধীন বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী (IPP) প্রকল্পসমূহের মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে, বিশেষ করে জ্বালানী তেলের বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল ও নবায়নযোগ্য খাতে। দেশে এলএনজি আমদানি টার্মিনাল, সোলার পার্ক, বিদ্যুৎ সংযোগ উন্নয়ন ইত্যাদিতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা উন্মুক্ত রয়েছে[36]। সরকার এই খাতে কর রেয়াত, ভ্যাট ছাড়, শুল্কমুক্ত যন্ত্রপাতি আমদানির সুবিধা এবং BOO/BOT ও PPP মডেলে দীর্ঘমেয়াদি পাওয়ার পারচেজ চুক্তির নিশ্চয়তা দিচ্ছে[36]। উদাহরণস্বরূপ, পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পে কর অবকাশ এবং বিশেষ ট্যারিফের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ করে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো স্থিতিশীল রিটার্নের সুযোগ এবং দ্রুত সম্প্রসারিত বাজারের অংশীদার হতে পারবে।
  10. অটোমোবাইল ও পরিবহণ যান শিল্প (Automotive & Transport Vehicles): ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও আয়ের উন্নতির সাথে বাংলাদেশে ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক যানবাহনের চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৯ সালেই দেশে প্রায় ২৬,০০০ ব্যক্তিগত গাড়ি এবং ৩৭,০০০ বাণিজ্যিক যানবাহন নিবন্ধিত হয়েছে[37], এবং পরবর্তীতে এ প্রবণতা উর্ধ্বমুখী। বর্তমানে দেশের মোটরযান বাজার আমদানিনির্ভর — বিক্রিত ব্যক্তিগত গাড়ির ৯৫% সম্পূর্ণরূপে আমদানিকৃত (CBU) এবং এর মধ্যে প্রায় ৮০% পুনর্ব্যবহৃত রিকন্ডিশন্ড যান[38]। তবে স্থানীয় সংযোজন ও উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে গাড়ির মূল্য ১৫-৪০% পর্যন্ত কমানো সম্ভব, যা মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াবে[39]। ইতোমধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান প্রগতি প্রতিবছর মিত্সুবিশি ব্র্যান্ডের SUV গাড়ি assembল করছে এবং অন্যান্য বেসরকারি গ্রুপও বিদেশি ব্র্যান্ডের গাড়ি দেশেই সংযোজন শুরু করেছে[40]। সরকার ২০২০ সালের নীতিমালার মাধ্যমে দেশীয় গাড়ি সংযোজন ও উৎপাদনকে উৎসাহিত করছে, যার অংশ হিসেবে সম্ভাব্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরকে জমি বরাদ্দ ও অন্যান্য সুবিধা দেওয়া হচ্ছে[41]। পাশাপাশি বৈদ্যুতিক যানবাহন (EV) উত্পাদনে আগ্রহী বিনিয়োগকারীদের আহ্বান জানানো হচ্ছে; একটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের বৈদ্যুতিক যান উৎপাদন প্রকল্প প্রস্তাব করেছে বলে জানা যায়[42]। গাড়ির যন্ত্রাংশ, মোটরসাইকেল উৎপাদন, এবং পরিবহন সেবার পার্শ্ব খাতগুলোতেও বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশে বিনিয়োগ: বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য সুযোগ ও নির্দেশিকা
বাংলাদেশে বিনিয়োগ: বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য সুযোগ ও নির্দেশিকা

বিনিয়োগের বিস্তারিত নির্দেশিকা: বিদেশি ও দেশীয় বিনিয়োগকারীদের করণীয়

বাংলাদেশে বিনিয়োগ প্রক্রিয়াকে সফল করতে বিনিয়োগকারীদের জন্য সুসংগঠিত পদক্ষেপসমূহ অনুসরণ করা জরুরি। বিশেষত বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে কিছু অতিরিক্ত বিধান ও অনুমোদনের প্রয়োজন হয়, তবে সামগ্রিকভাবে দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রক্রিয়াটি মিল রয়েছে। নিচে বিনিয়োগের ধাপে ধাপে নির্দেশিকা প্রদান করা হলো:

  • প্রারম্ভিক পরামর্শ ও গবেষণা: বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বাজার গবেষণা ও পরামর্শ গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভাব্য খাত চিহ্নিত করতে এবং বাজারের চাহিদা বুঝতে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (BIDA) বা বেসরকারি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা করতে পারেন। বাজার বিশ্লেষণ এবং সম্ভাব্য অংশীদার বা প্রতিযোগীদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করুন। সরকারি সংস্থা যেমন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (EPB) এবং বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ এই বিষয়ে উপাত্ত সরবরাহ করতে পারে।

 

  • নাম নিবন্ধন ও কোম্পানি গঠন: ব্যবসা শুরু করার জন্য প্রথমে কোম্পানির নাম নিবন্ধন (Name Clearance) করতে হবে। যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধক (RJSC) এর অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে পছন্দকৃত কোম্পানি নামের অনুমোদন নিতে হয়। নাম অনুমোদনের পর মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশন ও আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশন প্রণয়নপূর্বক RJSC-তে কোম্পানি নিবন্ধন সম্পন্ন করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এককভাবে ১০০% মালিকানায় কোম্পানি গঠন করতে পারেন কিংবা স্থানীয় অংশীদার নিয়ে যৌথ উদ্যোগ (Joint Venture) গঠন করতে পারেন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ১০০% বিদেশি মালিকানা সরকার কর্তৃক অনুমোদিত, কেবলমাত্র অস্ত্র-গোলাবারুদ ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ইত্যাদি কিছু সংরক্ষিত খাত ছাড়া বিনিয়োগে কোনো বাধা নেই[43]

 

 

  • লাইসেন্স ও কর নিবন্ধন: কোম্পানি নিবন্ধনের পর ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করতে প্রয়োজনীয় বাণিজ্য লাইসেন্স এবং কর নিবন্ধন করতে হবে। স্থানীয় সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা থেকে সংশ্লিষ্ট কাঠামোতে বাণিজ্য লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হয়। পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR) থেকে করদাতা সনাক্তকরণ নম্বর (TIN) এবং মূল্য সংযোজন কর (মূসক/VAT) নিবন্ধন নিতে হবে। বাংলাদেশে ব্যবসায় পরিচালনার জন্য TIN বাধ্যতামূলক এবং ভ্যাট নিবন্ধন নির্দিষ্ট টার্নওভারের বেশি হলে প্রয়োজন হয়। প্রয়োজনে আমদানি-রপ্তানি ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রধান নিয়ন্ত্রক (CCIE) থেকে আমদানি রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট (IRC) এবং রপ্তানি রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট (ERC) নিতে হতে পারে।

 

  • ব্যাংক হিসাব খোলা ও মূলধন প্রেরণ: কোম্পানির প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন হলে একটি স্থানীয় ব্যাংকে ব্যাংক হিসাব খুলতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে, এই ব্যাংক হিসাবেই বৈদেশিক মূলধনের অর্থ প্রেরণ করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধি অনুযায়ী বিদেশি বিনিয়োগ মূলধন স্বীকৃত বৈদেশিক মুদ্রায় দেশে আনতে হবে এবং অনুমোদিত ডিলার ব্যাংকের মাধ্যমে সেটি গ্রহণ করে বিনিয়োগ হিসাবে নিবন্ধন করতে হবে। বিনিয়োগকৃত অর্থ দেশের প্রচলিত মুদ্রা আইনে এবং বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী যথাযথভাবে হিসাবায়ন করতে হয়। ব্যাংক হিসাব খোলার সময় পুঁজির উত্স, বিনিয়োগকারীর পরিচিতি, কোম্পানির নিবন্ধন দলিল ইত্যাদি প্রদান করতে হয়।

 

  • বিনিয়োগ অনুমোদন ও BIDA নিবন্ধন: সম্পূর্ণ বিদেশি মালিকানাধীন বা যৌথ উদ্যোগে গঠিত কোম্পানিকে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (BIDA) نزد বিনিয়োগ নিবন্ধন করতে হয়। যদিও অনেক খাতে বিনিয়োগে পূর্বানুমোদনের প্রয়োজন নেই (স্বয়ংক্রিয় রুটে বিনিয়োগ), তবু বিদেশি বিনিয়োগকারীদের তথ্য ও সুবিধা প্রদানের জন্য BIDA-তে একটি নিবন্ধন/সংগঠনপূর্বক অনুমোদন নেয়া বাঞ্ছনীয়। BIDA এ নিবন্ধনের ফলে সরকারী সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ, ভিসা সুপারিশ, স্থানীয় ঋণগ্রহণ অনুমতি ও মুনাফা/লভ্যাংশ বিদেশে প্রেরণের ছাড়পত্র সহজ হয়। এছাড়া নির্দিষ্ট কিছু নিয়ন্ত্রিত খাতে (উদাহরণ: টেলিযোগাযোগ, ব্যাংকিং, বিমা) সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন আলাদাভাবে নিতে হতে পারে।

 

  • প্রয়োজনীয় লাইসেন্স ও অনুমতিসমূহ: ব্যবসার প্রকৃতির ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন অনুমোদন ও লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হয়। যেমন: উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠানের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিবেশ ছাড়পত্র, কারখানা স্থাপনের ক্ষেত্রে ফায়ার লাইসেন্স, বিশেষ ক্ষেত্রেBSTI অনুমোদন, ওষুধ কোম্পানির জন্য ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের লাইসেন্স ইত্যাদি। কর্মী নিয়োগের জন্য বিদেশি নাগরিক হলে শ্রম মন্ত্রণালয়/BOI (বর্তমান BIDA) এর ওয়ার্ক পারমিট নিতে হয়[44]। ব্যবসা শুরু করার পূর্বে এসব অনুমোদন নিয়ে আসা আইনত জরুরি এবং ওয়ান-স্টপ সার্ভিস কেন্দ্রের মাধ্যমেও অনেক অনুমোদন এখন এক জায়গায় পাওয়া যাচ্ছে।

 

  • কার্যালয় স্থাপন ও কর্মীবাহিনী নিয়োগ: সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলে অফিস স্থাপন ও ব্যবসার কার্যক্রম শুরু করতে হয়। উপযুক্ত কার্য্যালয়/কারখানা স্থাপনের পর প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্থানীয়/বিদেশি কর্মী নিয়োগ করতে হবে। বাংলাদেশে দক্ষ ও অর্ধদক্ষ শ্রমশক্তি সহজলভ্য এবং মজুরি তুলনামূলকভাবে প্রতিযোগিতামূলক। বিদেশি ব্যবস্থাপক বা বিশেষজ্ঞ নিয়ে আসতে হলে যথাযথ ওয়ার্ক পারমিট ও ভিসা নিশ্চিত করতে হবে। কোম্পানির অভ্যন্তরীণ নীতিমালা তৈরি, ব্যাংক হিসাব পরিচালনা, সরবরাহকারী ও ক্রেতাদের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন ইত্যাদি কার্যক্রম এ পর্যায়ে পরিচালিত হয়।

 

  • নিরবিচ্ছিন্ন নিয়ন্ত্রণ ও আনুষ্ঠানিকতা পালন: কোম্পানি চালু হওয়ার পর নিয়মিত অর্থনৈতিক ও আইনি আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে প্রতি বছর নির্ধারিত সময়ে বার্ষিক অডিটকৃত হিসাব জমা দেওয়া, কর রিটার্ন দাখিল, ভ্যাট রিটার্ন দাখিল, RJSC তে বার্ষিক সাধারণ সভার প্রতিবেদন ও রিটার্ন জমা ইত্যাদি[45][46]। এছাড়া BIDA এবং সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর চাহিদা অনুযায়ী বিনিয়োগ সংক্রান্ত রিপোর্টিং (যেমন বিদেশি বিনিয়োগের বার্ষিক পরিস্থিতি প্রতিবেদন) জমা দিতে হয়[47]। বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে আর্থিক বছর শেষের ছয় মাসের মধ্যে বার্ষিক হিসাব বিবরণী ও আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সময়মত এসব দায়বদ্ধতা পূরণ না করলে জরিমানা বা আইনি জটিলতা হতে পারে। ব্যবসা চলাকালে শ্রম আইন, পরিবেশ আইনসহ প্রযোজ্য সকল আইন মেনে চলা এবং প্রয়োজনে লাইসেন্স নবায়ন ও নিয়মিত পরিদর্শনের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে[48]। সুশাসন ও নিয়ন্ত্রক নির্দেশিকা মেনে চলার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা তাদের ব্যবসা ঝুঁকিমুক্ত ও সফলভাবে পরিচালনা করতে পারবেন।

 

উল্লেখ্য: দেশীয় বিনিয়োগকারীদের জন্যও উপরোক্ত অধিকাংশ ধাপ প্রযোজ্য, তবে তাদের বৈদেশিক মুদ্রা সংক্রান্ত অনুমোদন বা ওয়ার্ক পারমিট ইত্যাদি নিতে হয় না। স্থানীয় উদ্যোগে BIDA নিবন্ধন ঐচ্ছিক হলেও সরকারি পরিসংখ্যান ও সুবিধার জন্য তাও উৎসাহিত করা হয়। বিনিয়োগের পুরো প্রক্রিয়ায় BIDA সহায়তা ও পরামর্শ প্রদান করে থাকে, বিশেষ করে তাদের ওয়ান-স্টপ সার্ভিসের মাধ্যমে এক জায়গায় বিভিন্ন সেবা পাওয়া যায়।

Digital Marketing for Bangladeshi Businesses to Reach Global Audiences
digital marketing

সাম্প্রতিক সরকারী ও BIDA উদ্যোগ

বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (BIDA) বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নে বিগত বছরে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর মূল উদ্দেশ্য দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি অনুকূল, সহজ ও নির্ভরযোগ্য পরিবেশ সৃষ্টি করা। এসব উদ্যোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো:

  • ওয়ান-স্টপ সার্ভিস (OSS): বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন অনুমোদন ও সেবা এক ছাতার নিচে প্রদানের জন্য BIDA একটি ওয়ান-স্টপ সার্ভিস প্ল্যাটফর্ম চালু করেছে[49]। এর মাধ্যমে কোম্পানি নিবন্ধন, ভূমি বরাদ্দ, পরিবেশগত ছাড়পত্র, ইউটিলিটি সংযোগ, কর শনাক্তকরণসহ প্রায় ৫০টির বেশি সেবা অনলাইনে অথবা একই কেন্দ্রে সরবরাহ করা হচ্ছে। যদিও OSS পুরোপুরি যথাপর্যায়ে কার্যকর করতে সময় লেগেছে, বর্তমানে এটি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমিয়ে বিনিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুততর করতে সহায়তা করছে[50][51]। বিনিয়োগকারী সম্পর্ক ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে সম্প্রতি BIDA বেসরকারি খাত থেকে প্রশিক্ষিত সম্পর্ক ব্যবস্থাপক নিয়োগ করেছে, যারা গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগকারীদের প্রকল্প বাস্তবায়নে শুরু থেকে সহযোগিতা করছেন (এটি বিনিয়োগ সহায়তায় একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি)।

 

  • বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (SEZ) ও শিল্প পার্ক: সরকার দেশজুড়ে বহু বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে যাতে বিনিয়োগকারীদের জন্য উন্নত অবকাঠামো, কর প্রণোদনা এবং সুবিধাসম্পন্ন জমি প্রদান করা যায়[52]। বর্তমানে ১০০টিরও বেশি অর্থনৈতিক অঞ্চল ও উচ্চ প্রযুক্তি পার্ক চালু বা পরিকল্পনাধীন আছে[53]। মীরসরাই, মোংলা, কুমিল্লা, কৃষ্ণপুরের মতো SEZ গুলোতে বিনিয়োগকারীরা দ্রুত অনুমোদন, প্রস্তুত কারখানা ভবন, বিদ্যুৎ-পানি-ইন্টারনেট সংযোগ এবং বনডেড গুদাম সুবিধা পাচ্ছেন[54][55]। এসব অঞ্চলে ৫-১০ বছরের কর অবকাশ, আমদানি শুল্ক মওকুফ, ভ্যাট রেয়াত, রপ্তানি আয়ের ওপর কর ছাড় ইত্যাদি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। সরকারের লক্ষ্য হলো প্রতিটি অঞ্চলে বিশেষ বিশেষ খাতের ক্লাস্টার গড়ে তুলে বিনিয়োগ সম্প্রসারণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা।

 

  • নীতিমালা সংস্কার ও প্রণোদনা: বিনিয়োগ সহজ করার জন্য সরকার নানাবিধ নীতিমালা সংস্কার করেছে। কোম্পানি নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজ ও সম্পূর্ণ অনলাইনভিত্তিক করা হয়েছে[56]। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য লাভ ও মূলধন সম্পূর্ণ পুনর্বহির্ভূত (repatriation) করার অনুমতি রয়েছে[57], যা বিনিয়োগ ফিরিয়ে নেওয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করে। বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ, রয়্যালটি ও প্রযুক্তি ফি পাঠানো ইত্যাদির অনুমোদন প্রক্রিয়াও সহজতর করা হয়েছে। কর কাঠামোতেও বিনিয়োগ促促ণে বিশেষ সুবিধা আছে – যেমন নবীন শিল্প ও অবকাঠামো খাতে কর অবকাশ, রপ্তানি আয়ে কর মওকুফ, নির্দিষ্ট খাতে ভ্যাট ও শুল্ক রেয়াত। ২০২৩-২৪ বাজেটে কিছু উদীয়মান খাতে কর কমানো এবং স্টার্টআপগুলোকে কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। সরকার ব্যবসা করার সহজ সূচকে (Ease of Doing Business) উন্নতি আনার জন্য কোম্পানি আইন হালনাগাদ, দেওলিয়া আইন প্রণয়ন এবং কর পদ্ধতি সহজীকরণের উদ্যোগ নিয়েছে।

 

  • বিনিয়োগ প্রচার ও আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব: BIDA দেশ-বিদেশে বাংলাদেশের বিনিয়োগ সুযোগ প্রচারের জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ নিয়েছে। নিয়মিতভাবে বিনিয়োগ সম্মেলন ও রোডশো আয়োজন করা হচ্ছে – উদাহরণस्वरূপ, ২০২৫ সালে গ্লোবাল ইনভেস্টমেন্ট সামিট অনুষ্ঠিত হয়েছে যেখানে বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারী ও প্রতিষ্ঠানের সাথে B2B আলোচনা হয়েছে[58]। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের বিনিয়োগ সম্ভাবনা তুলে ধরতে সরকার রাজনীতিক ও কূটনৈতিক চ্যানেল ব্যবহার করছে। সম্প্রতি BIDA ১৯টি সম্ভাবনাময় খাতে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা চিহ্নিত করার জন্য একটি FDI Heatmap উন্মোচন করেছে[59], যার মাধ্যমে খাতওয়ারী বিনিয়োগ প্রবাহ পর্যবেক্ষণ ও প্রচার সহজ হবে। এছাড়া, বিনিয়োগ পরবর্তী সেবার অংশ হিসেবে BIDA একটি বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ নিষ্পত্তি কক্ষ স্থাপন করেছে, যেখানে বিনিয়োগকারীরা তাদের সমস্যার দ্রুত সমাধান পেতে পারেন।

 

  • বিশেষ প্রণোদনা ও সহায়তা: রপ্তানি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সরকারের বিভিন্ন নগদ সহায়তা কর্মসূচি রয়েছে (যেমন আইটি সেবা রপ্তানিতে ১০% নগদ প্রণোদনা, চামড়াজাত পণ্যে ১৫% ইত্যাদি)। উচ্চ প্রাথমিক বিনিয়োগের প্রকল্পগুলোর জন্য সরকার কেস-বাই-কেস ভিত্তিতে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, বড় বিদ্যুৎ প্রকল্প বা অবকাঠামো প্রকল্পে ভ্যাট ও শুল্ক মওকুফ, ভূমি লিজে রেয়াত, দ্রুত পরিবেশ অনুমোদন ইত্যাদি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের দ্রুত সেবা দিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অন্যান্য সংস্থার সাথে সমন্বয় বৃদ্ধি করা হয়েছে। সমন্বিত প্রচেষ্টায়, বিনিয়োগ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলোকে দ্রত বাস্তবায়নে জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি বিনিয়োগ সহায়ক কমিটি সক্রিয় রয়েছে, যেটি উচ্চ পর্যায়ে নীতিনির্ধারণী সহায়তা দেয়।

 

সামগ্রিকভাবে, এসব উদ্যোগ দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতিকে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নয়ন করেছে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবশ্য এখনো কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও নীতিগত স্থিরতার অভাব রয়ে গেছে, তবে সরকার ও BIDA ক্রমাগত এসব বাধা দূর করতে সচেষ্ট রয়েছে।

bbcci
BBCCI

আইনি ও নীতিগত কাঠামো

বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুরক্ষা ও সুবিধার জন্য একটি সুস্পষ্ট আইনি কাঠামো ও নীতিমালা বিদ্যমান রয়েছে। দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অধিকার রক্ষা, সম্পত্তির সুরক্ষা ও সমান সুবিধা প্রদানে সরকারের প্রতিশ্রুতি বিভিন্ন আইন ও চুক্তির মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে। নিচে এই কাঠামোর প্রধান দিকগুলো তুলে ধরা হলো:

  • বৈদেশিক বিনিয়োগ সুরক্ষা আইন: বিদেশি বেসরকারি বিনিয়োগ (প্রচার ও সুরক্ষা) আইন, ১৯৮০ বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি মূল আইন, যা বিদেশি সম্পদের জাতীয়করণ বা অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে নিশ্চয়তা প্রদান করে[60]। এই আইনের অধীনে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের সমান অধিকার ও সুবিধা ভোগ করেন এবং সরকারের নীতিতে কোনো পরিবর্তন হলে ক্ষতিপূরণের নিশ্চয়তা পান। এ আইন বিদেশি বিনিয়োগের মুনাফা ও মূলধন পূর্ণাঙ্গভাবে বিদেশে ফেরত পাঠানোর (repatriation) অধিকার দেয়, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য অত্যন্ত আশ্বাসবাণী একটি দিক[61][57]

 

  • বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১৬: এই আইনের মাধ্যমে বিনিয়োগ বোর্ড ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিওআই কে একীভূত করে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (BIDA) গঠন করা হয়। BIDA দেশের কেন্দ্রীয় বিনিয়োগ প্রচার সংস্থা হিসেবে কাজ করছে[62]। এ আইন অনুযায়ী BIDA বিনিয়োগ প্রচার, বিনিয়োগকারীদের সহায়তা, বিনিয়োগ সংক্রান্ত নীতি সংস্কারের পরামর্শ এবং ওয়ান-স্টপ সার্ভিস পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত। এর ফলে বিনিয়োগ প্রক্রিয়া কেন্দ্রিয়ভাবে সমন্বিত হয়েছে এবং এক দরজায় সেবা পাওয়ার আইনগত ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

 

  • দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ চুক্তি ও আন্তর্জাতিক সুরক্ষা: বাংলাদেশ প্রায় ৩০টিরও বেশি দেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ চুক্তি (BIT) স্বাক্ষর করেছে, যাতে পারস্পরিক বিনিয়োগ সুরক্ষা ও সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে[63]। এসব চুক্তির আওতায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বৈষম্যহীন আচরণ, ন্যায্য ও সুবিবেচনাপ্রসূত আচরণ এবং বিরোধ নিষ্পত্তির নিশ্চয়তা পেয়ে থাকেন। বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীর Multilateral Investment Guarantee Agency (MIGA)-এর সদস্য, ফলে MIGA রাজনৈতিক ঝুঁকি বীমার মাধ্যমে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ঝুঁকি হ্রাসের সুযোগ দেয়[64]। বিনিয়োগ বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ বিরোধ নিষ্পত্তি কেন্দ্রের (ICSID) সদস্য[65], যা কোনো বিদেশি বিনিয়োগকারীর সাথে সরকারের বিরোধের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সালিশিকে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করে। এই আন্তর্জাতিক সংযুক্তি ও চুক্তিসমূহ বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ায় এবং আইনগত সুরক্ষা জোরদার করে।

 

  • বাণিজ্য ও শিল্প নীতিমালা: বাংলাদেশ সরকার বিনিয়োগ আকর্ষণে এক উদার শিল্প ও বাণিজ্য নীতি অনুসরণ করছে। বর্তমান শিল্পনীতি ও বিনিয়োগ নীতিতে বেশিরভাগ খাতেই ১০০% বিদেশি মালিকানার অনুমতি রয়েছে এবং যৌথ উদ্যোগকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। মাত্র কয়েকটি সংরক্ষিত খাত (যেমন: অস্ত্রশস্ত্র, পরমাণু শক্তি, মাদকদ্রব্য প্রভৃতি) ছাড়া সব ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগের অনুমতি স্বয়ংক্রিয় রুটে পাওয়া যায়[43]। রপ্তানিমুখী শিল্প ও উচ্চ প্রযুক্তি খাতে অতিরিক্ত প্রণোদনা প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়া ২০১৭ সালের বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদন অনুযায়ী সরকার কর্পোরেট কর হার পর্যায়ক্রমে হ্রাস এবং ব্যবসাবান্ধব শুল্ক কাঠামো গড়ে তোলার প্রচেষ্টা করছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (BEZA) ও রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (BEPZA) আছে, যারা সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগকারীদের আইনি সহায়তা ও নীতিগত সুবিধা নিশ্চিত করে।

 

  • কর ও আর্থিক নীতিকাঠামো: কর্পোরেট করহার বাংলাদেশে তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য ভিন্ন (বর্তমানে অতালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য প্রায় ২২.৫% এবং নির্দিষ্ট কিছু খাতে, যেমন তামাক, সর্বোচ্চ ৪০%)। মানসম্পন্ন বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকার নানা কর রেয়াত দিয়েছে – যেমন রপ্তানিমুখী কোম্পানির জন্য কর ছাড়, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৫ থেকে ১০ বছরের কর অবকাশ[66], নতুন শিল্প স্থাপনে ত্বরিত অবমূল্যায়ন সুবিধা, প্রাথমিক পর্যায়ে শুল্ক মুক্ত যন্ত্রপাতি আমদানির সুবিধা ইত্যাদি। ভ্যাটের সাধারণ হার ১৫%, তবে অনেক পণ্য ও সেবায় হ্রাসকৃত হার বা অব্যাহতি আছে[66]। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ পাঠানো, প্রযুক্তি ফি পরিশোধ, পরিচালনা ফি ইত্যাদিতে উৎসে কর ১০-২০% কাটা হয়, তবে যেসব দেশের সাথে দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি (DTT) রয়েছে সেসব ক্ষেত্রে এই হার কম প্রযোজ্য হয়[66]। বাংলাদেশ ৩৬টিরও বেশি দেশের সাথে দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দ্বিগুণ করের বোঝা এড়াতে সহায়তা করে। তদুপরি, বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক মুনাফা ও লভ্যাংশ অনায়াসে প্রেরণের অনুমতি দেয় এবং ফরেন কারেন্সি নিয়মাবলি শিথিল করেছে[67][57]। সামগ্রিকভাবে, বাংলাদেশের কর ও আর্থিক নীতিকাঠামো বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা প্রদান করে এবং আঞ্চলিক তুলনায় অনেক ক্ষেত্রে উদার।

 

উপরোক্ত আইনি ও নীতিগত কাঠামো বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি নিরাপদ ও স্থিতিশীল পরিবেশ নিশ্চিত করে। তবে বিনিয়োগকারীদের পরামর্শ দেওয়া হয় যে কোনো প্রকল্প শুরু করার আগে আইন ও নীতিমালা সম্পর্কে হালনাগাদ ধারণা নিতে এবং প্রয়োজনে আইনজীবী বা বিনিয়োগ পরামর্শকের সাহায্য নিতে। বাংলাদেশ সরকার বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট আইনসমূহ সময়ের সাথে হালনাগাদ করছে এবং একটি প্রেডিক্টেবল (অনুমেয়) নীতিগত পরিবেশ বজায় রাখতে সচেষ্ট।

কিভাবে ব্রাজিলে রপ্তানি করবেন (২০২৬): বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের জন্য ধাপে-ধাপে নির্দেশিকা

উপসংহার: বাংলাদেশের বিনিয়োগ সম্ভাবনা ও পথচিত্র

উপরে আলোচিত পূর্ণাঙ্গ নির্দেশিকা এবং খাতভিত্তিক পর্যালোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে বাংলাদেশ বর্তমানে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগের জন্য এক আকর্ষণীয় গন্তব্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুত-বিকাশমান অর্থনীতি হিসাবে বাংলাদেশের অনন্য কিছু সুবিধা রয়েছে – বিশাল যুবসমৃদ্ধ জনবল, ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত ভোক্তা শ্রেণি, ভৌগোলিকভাবে কৌশলগত অবস্থান, এবং নীতিনির্ধারণীদের অব্যাহত সংস্কার প্রচেষ্টা। বিনিয়োগ অবকাঠামো উন্নয়নে চলমান প্রকল্পসমূহ (যেমন নতুন বন্দর, সড়ক নেটওয়ার্ক, বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি) ভবিষ্যতে ব্যবসার পরিবেশকে আরও অনুকূল করে তুলবে।

 

বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগে বিনিয়োগকারীদের উচিত যথাযথ অধ্যয়ন ও সতর্কতা অবলম্বন করা – রাজনৈতিক ও নিয়ন্ত্রক পরিবর্তনের ঝুঁকি বিবেচনা করা, উপযুক্ত স্থানীয় অংশীদার নির্বাচন করা এবং সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জের (যেমন আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অবকাঠামো ঘাটতি) জন্য পূর্বপ্রস্তুতি রাখা[68][69]। সরকার দিক থেকে নীতিগত ধারাবাহিকতা, নিয়ন্ত্রক স্থিতিশীলতা ও দুর্নীতিমুক্ত সেবা নিশ্চিত করা জরুরি, যাতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা আরো বাড়ে[50]। ওয়ান-স্টপ সার্ভিস পূর্ণ সক্ষমতা অর্জন ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সমন্বয় বৃদ্ধি পেলে بيرোক্রাসির বাধা অনেকটাই কমে যাবে। একই সাথে জ্বালানি ও লজিস্টিক অবকাঠামোতে চলমান বিনিয়োগ অর্থনীতিকে আরও সক্ষম করে তুলবে[70]

 

অন্যদিকে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার মাঝেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের জোরালো চাহিদা, বহুমুখী রপ্তানি খাত এবং প্রবাসী আয়ের প্রবাহ অর্থনীতিকে প্রাণবন্ত রেখেছে। বিনিয়োগকারীরা যদি কৌশলগতভাবে খাত নির্বাচন করেন – যেমন তথ্যপ্রযুক্তি, উচ্চমূল্যের টেক্সটাইল, ফার্মাসিউটিক্যাল API ইত্যাদি যেখানে নীতি সহায়তা দৃঢ়[71] – এবং স্থানীয় অভিজ্ঞ অংশীদারের সাথে মিলিত হন, তবে ঝুঁকি হ্রাসের পাশাপাশি সাফল্যের সম্ভাবনা বাড়বে। প্রতিটি বিনিয়োগ উদ্যোগের আগে রাজনৈতিক ও নীতিগত পরিবেশের গভীর বিশ্লেষণ (Due Diligence) করা বাঞ্ছনীয়, যাতে বাজারের সাধারণ অর্থনৈতিক বিচারের বাইরে গিয়ে সম্ভাব্য ঝুঁকি ও সুযোগগুলো পরিমাপ করা যায়[67][72]

 

সব মিলিয়ে, বাংলাদেশে বিনিয়োগ একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত হতে পারে। উৎপাদন থেকে পরিষেবা, অবকাঠামো থেকে প্রযুক্তি – সর্বত্রই প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা বিদ্যমান। সরকার এবং বেসরকারি খাত উভয়ে দেশের অর্থনীতিকে পরবর্তী পর্যায়ে নিতে আগ্রহী এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে। সঠিক তথ্য, পরিকল্পনা ও অংশীদারিত্ব নিয়ে এগোলে বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী হিসাবে সফল হওয়ার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত। এই উদীয়মান বাজারে বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘমেয়াদে উল্লেখযোগ্য রিটার্নের পাশাপাশি একটি ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির অগ্রগতির অংশীদার হওয়ার সুযোগ পাবেন। বাংলাদেশ তাঁর দ্বার উন্মুক্ত রেখেছে এখন দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার পালা আপনার।

 

[1] [2] [3] [5] [7] [36] [53] [54] [55] [63] [64] [65] [66] Foreign Investment in Bangladesh: A 2025 Guide to Opportunities, Sectors, and Economic Potential

https://www.linkedin.com/pulse/foreign-investment-bangladesh-2025-guide-opportunities-sectors-dicec

[4] [6] [10] [11] [12] [13] [14] [15] [16] [17] [18] [19] [20] [21] [22] [23] [24] [25] [26] [27] [28] [29] [30] [31] [32] [33] [34] [35] [37] [38] [39] [40] [41] [42] REAB – Reviews of markets and investment niches – Investment opportunities in Bangladesh

https://reab.pro/en/info/market-reviews/investment-opportunities-in-bangladesh

[8] [9] [44] [45] [46] [47] [48] [49] [50] [51] [52] [56] [57] [60] [61] [62] [67] [68] [69] [70] [71] [72] Bangladesh Investment Guide • LegalSeba Bangladesh

https://legalseba.com/bangladesh-investment-guide/

[43] 2025 Investment Climate Statements: Bangladesh

https://www.state.gov/reports/2025-investment-climate-statements/bangladesh

[58] Bangladesh Investment Summit 2025 – Global Investment Hub – BIDA

https://summit.bida.gov.bd/

[59] Bangladesh Investment Development Authority – BIDA

https://bida.gov.bd/press-release/bida-unveils-fdi-heatmap-to-drive-targeted-investment-across-19-sectors