ব্রাজিল–বাংলাদেশ বাণিজ্যের সামগ্রিক চিত্র

ব্রাজিল–বাংলাদেশ বাণিজ্যের সামগ্রিক চিত্র

 

মোঃ জয়নাল আব্দীন
প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট বাংলাদেশ (T&IB)
নির্বাহী পরিচালক, অনলাইন ট্রেনিং একাডেমি (OTA)
মহাসচিব, ব্রাজিল–বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (BBCCI)

 

ব্রাজিলের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য পরিমাণে তুলনামূলকভাবে এখনও সীমিত হলেও ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২৪ সালে ব্রাজিল বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৫৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করেছে, যার বড় অংশ ছিল তৈরি পোশাক। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে ব্রাজিলে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রায় ২৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১৮৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা আগের অর্থবছরে ছিল প্রায় ১৪৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিপরীতে, একই সময়ে বাংলাদেশে ব্রাজিলের রপ্তানি ছিল প্রায় ২.৬৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার

 

এই পরিসংখ্যানগুলো প্রমাণ করে যে ব্রাজিলীয় বাজারে বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনা দ্রুত বাড়ছে। ব্রাজিলের ১০ কোটিরও বেশি মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী ক্রমবর্ধমানভাবে পোশাক, বস্ত্র, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, পাট ও অন্যান্য মূল্যসংযোজিত পণ্য আমদানি করছে। তবে এই বাজারে সফল হতে হলে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের অবশ্যই ব্রাজিলের জটিল আমদানি বিধিমালা ও কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স প্রক্রিয়া যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে।

 

ব্রাজিলের আমদানি বিধিমালা ২০২৫

ব্রাজিলে সাধারণভাবে আমদানির ওপর কোনো কোটা নেই, তবে সব ধরনের আমদানিকে নির্ধারিত নিয়ন্ত্রক কাঠামো ও শ্রেণিবিন্যাস পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়।

 

আমদানি নিবন্ধন (SISCOMEX / RADAR):

প্রতিটি ব্রাজিলীয় আমদানিকারককে অবশ্যই ফেডারেল সরকারের অধীন SISCOMEX (Sistema Integrado de Comércio Exterior)-এ নিবন্ধিত হতে হয়, যা পররাষ্ট্র বাণিজ্য সচিবালয় (SECEX) পরিচালনা করে। একই সঙ্গে SISCOMEX ব্যবহারের জন্য RADAR লাইসেন্স (Registro e Rastreamento da Atuação dos Intervenientes Aduaneiros) থাকা বাধ্যতামূলক। বাস্তবে, বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা সাধারণত ব্রাজিলে নিবন্ধিত কোনো আমদানিকারক বা পরিবেশকের মাধ্যমে পণ্য পাঠান, যাদের কাছে প্রয়োজনীয় RADAR অনুমোদন থাকে।

 

যেসব পণ্যের জন্য বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন, সেগুলোর ক্ষেত্রে SISCOMEX-এর মাধ্যমে আমদানি লাইসেন্স গ্রহণ করতে হয়, যা সাধারণত পণ্য প্রেরণের আগেই সংগ্রহ করা উচিত। কিছু জরুরি ক্ষেত্রে পণ্য বন্দরে পৌঁছানোর পরও, তবে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের আগে, লাইসেন্স দেওয়া হতে পারে।

 

পণ্যভিত্তিক অনুমোদন

কিছু নির্দিষ্ট পণ্যের ক্ষেত্রে ব্রাজিলে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, খাদ্যপণ্য, ওষুধ, কসমেটিকস এবং মানবদেহে ব্যবহৃত বা প্রভাব ফেলে এমন যেকোনো পণ্যকে ব্রাজিলের স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা ANVISA-এর কাছে নিবন্ধন করতে হয় এবং সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য সনদ জমা দিতে হয়।

উদ্ভিদ ও প্রাণিজ পণ্য যেমন মসলা, কৃষিপণ্য, পশুর চামড়া ইত্যাদির জন্য MAPA (Ministry of Agriculture) কর্তৃক নিবন্ধন এবং বাংলাদেশ থেকে ইস্যুকৃত ফাইটোস্যানিটারি বা ফিউমিগেশন সার্টিফিকেট আবশ্যক।

 

ইলেকট্রনিক্স, গৃহস্থালি যন্ত্রপাতি ও খেলনার ক্ষেত্রে INMETRO সার্টিফিকেশন প্রয়োজন হয় এবং টেলিকমিউনিকেশন সরঞ্জামের জন্য ANATEL অনুমোদন বাধ্যতামূলক। এসব শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স স্থগিত হতে পারে বা জরিমানার সম্মুখীন হতে হয়।

 

২০২৫ সাল নাগাদ ব্রাজিল ধাপে ধাপে একটি নতুন সিঙ্গেল উইন্ডো আমদানি ব্যবস্থা চালু করছে, যা DUIMP (Declaração Única de Importação) নামে পরিচিত। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে পূর্বের একাধিক আলাদা আমদানি ফর্ম ও লাইসেন্স একীভূত করে Portal Único-তে পরিচালিত হবে, ফলে আমদানি প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ ও দ্রুত হবে।

ব্রাজিল–বাংলাদেশ বাণিজ্যের সামগ্রিক চিত্র
বাংলাদেশে দ্রুত নগদ প্রবাহের সুযোগ সৃষ্টিকারী ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক মডেল বিশ্লেষণ

শ্রেণিবিন্যাস শুল্ক

ব্রাজিল Mercosur Common Nomenclature (NCM) ব্যবহার করে, যা আন্তর্জাতিক HS কোডের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের অবশ্যই সঠিক HS/NCM কোড ব্যবহার করতে হবে, কারণ এর ওপরই শুল্ক, কর এবং লাইসেন্স নির্ভর করে। সাধারণভাবে শুল্কহার ০–৩৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে, যার সঙ্গে আমদানি শুল্ক, ভ্যাট (ICMS), PIS/COFINS ইত্যাদি যুক্ত হয়।

 

বর্তমানে বাংলাদেশ ও ব্রাজিলের মধ্যে কোনো কার্যকর মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA) বা অগ্রাধিকারমূলক চুক্তি (PTA) নেই, ফলে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর মারকোসুরের সাধারণ শুল্কহার প্রযোজ্য হয়। সব নথিতে পণ্যের বিবরণ, মূল্য ও উৎপত্তি দেশ সঠিক ও একরূপ হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সামান্য অমিলও কাস্টমস পরিদর্শন ও জরিমানার কারণ হতে পারে।

 

সমুদ্রপথে পণ্যের কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স প্রক্রিয়া

বাংলাদেশ থেকে ব্রাজিলে রপ্তানি হওয়া অধিকাংশ পণ্যই সমুদ্রপথে কন্টেইনারের মাধ্যমে পাঠানো হয়। পণ্য ব্রাজিলের বন্দরে পৌঁছানোর পর আমদানিকারক বা তার নিয়োজিত কাস্টমস ব্রোকার SISCOMEX বা Portal Único-এর মাধ্যমে কাস্টমস ঘোষণা দাখিল করে। এই প্রক্রিয়ার মূল ধাপগুলো হলো—ডকুমেন্ট প্রি-ক্লিয়ারেন্স, পণ্য আগমন, পরিদর্শন এবং চূড়ান্ত ছাড়পত্র প্রদান।

 

ব্রাজিলের সান্তোস ও রিও ডি জেনেইরো বন্দরে আধুনিক কন্টেইনার হ্যান্ডলিং ব্যবস্থা রয়েছে। দ্রুত ক্লিয়ারেন্সের জন্য বিল অব লেডিং, কমার্শিয়াল ইনভয়েস ও সার্টিফিকেট অব অরিজিন সঠিকভাবে প্রস্তুত থাকা জরুরি। আমদানিকারকদের উচিত পণ্য পৌঁছানোর আগেই SISCOMEX-এ নিবন্ধন সম্পন্ন করা এবং ডেমারেজ এড়াতে বন্দরের ফ্রি-টাইম এক্সটেনশন (সাধারণত ২১–৩০ দিন) আবেদন করা। অভিজ্ঞ কাস্টমস ব্রোকারের সহায়তা নিলে বিধিবিধান মেনে চলা সহজ হয় এবং যেকোনো জটিলতা দ্রুত সমাধান করা যায়।

 

প্রয়োজনীয় নথিপত্র

সমুদ্রপথে ব্রাজিলে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের জন্য সাধারণত নিম্নোক্ত নথিগুলো প্রয়োজন হয়:

নথির নামউদ্দেশ্য / বিবরণ
কমার্শিয়াল ইনভয়েসপণ্যের বিস্তারিত বিবরণ, পরিমাণ, একক মূল্য, মোট মূল্য, বিক্রেতা ও ক্রেতার তথ্য এবং Incoterms উল্লেখ থাকতে হবে।
প্যাকিং লিস্টপ্রতিটি প্যাকেজ বা কন্টেইনারে কী আছে তার তালিকা, ওজন ও মাত্রা উল্লেখ থাকে।
বিল অব লেডিংসমুদ্র পরিবহন নথি; এতে কনসাইনি, কর শনাক্তকরণ নম্বর (CNPJ/CPF) ও HS/NCM কোড উল্লেখ থাকে।
সার্টিফিকেট অব অরিজিনবাংলাদেশের চেম্বার অব কমার্স কর্তৃক ইস্যুকৃত; পণ্যের উৎপত্তি দেশ নিশ্চিত করে।
আমদানি লাইসেন্স / পারমিটনিয়ন্ত্রিত পণ্যের ক্ষেত্রে প্রয়োজন।
ANVISA স্বাস্থ্য সনদখাদ্য, পানীয়, ওষুধ, কসমেটিকস ইত্যাদির জন্য।
ফাইটোস্যানিটারি সার্টিফিকেটউদ্ভিদ ও প্রাণিজ পণ্যের জন্য।
INMETRO / ANATEL সনদইলেকট্রনিক্স ও টেলিকম সরঞ্জামের ক্ষেত্রে।
বীমা নথিসামুদ্রিক বীমা থাকলে তার কপি।

সব নথির তথ্য একে অপরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া বাধ্যতামূলক।

Export Support Services in Bangladesh: Taking Local Businesses Global
বাংলাদেশের আম রপ্তানির সম্ভাবনা ও পরিপ্রেক্ষিত

কমপ্লায়েন্স সাধারণ ভুলত্রুটি

ব্রাজিলের আমদানি আইন অত্যন্ত কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়। সবচেয়ে সাধারণ ভুলগুলো হলো

ডকুমেন্টের তথ্যের মধ্যে অমিল, ভুল HS/NCM কোড ব্যবহার, প্রয়োজনীয় লাইসেন্স বা নিবন্ধন না থাকা, অস্পষ্ট পণ্যের বিবরণ, অথবা পণ্যের মূল্য কম দেখানো। এসব কারণে কাস্টমস পরিদর্শন, বিলম্ব ও জরিমানা হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ভুল HS কোড ব্যবহারের জন্য পণ্যের ঘোষিত মূল্যের কমপক্ষে ১ শতাংশ জরিমানা আরোপ করা হয়, যা ন্যূনতম নির্ধারিত অঙ্কের কম হতে পারে না।

এই ঝুঁকি এড়াতে দক্ষ কাস্টমস ব্রোকার ও পণ্য শ্রেণিবিন্যাস বিশেষজ্ঞের সহায়তা নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

 

আইন লঙ্ঘনের শাস্তি বিলম্ব নিরসন

ব্রাজিলে আমদানি সংক্রান্ত আইন লঙ্ঘনের জন্য জরিমানা অত্যন্ত কঠোর। লাইসেন্স ছাড়া আমদানির ক্ষেত্রে পণ্যের শুল্কযোগ্য মূল্যের সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। ইচ্ছাকৃত মূল্য কম দেখানো বা জালিয়াতির ক্ষেত্রে কর ফাঁকির ওপর ৭৫–১৫০ শতাংশ পর্যন্ত জরিমানা আরোপ হতে পারে, এমনকি পণ্য বাজেয়াপ্তও হতে পারে।

 

কাস্টমস হোল্ড বা জরিমানার ক্ষেত্রে সাধারণত সংশোধিত নথি জমা দিয়ে এবং নির্ধারিত জরিমানা পরিশোধ করে সমস্যার সমাধান করতে হয়। সামান্য ত্রুটির ক্ষেত্রে পুনরায় নথি দাখিল করে ক্লিয়ারেন্স পাওয়া সম্ভব।

 

বিলম্ব এড়ানোর সর্বোত্তম উপায় হলো পণ্য প্রেরণের আগেই সব নথি যাচাই করা, সঠিক ঘোষণা দেওয়া এবং ব্রাজিলীয় আমদানিকারক, কাস্টমস ব্রোকার ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় বজায় রাখা।

 

উপসংহার

২০২৫ সালে ব্রাজিলের বাজার বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনাময় গন্তব্য হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। তবে এই বাজারে প্রবেশ ও টিকে থাকতে হলে ব্রাজিলের আমদানি বিধিমালা, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স প্রক্রিয়া এবং কমপ্লায়েন্স শর্ত সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা অপরিহার্য। সঠিক নথিপত্র, যথাযথ শ্রেণিবিন্যাস, প্রয়োজনীয় লাইসেন্স এবং অভিজ্ঞ কাস্টমস ব্রোকারের সহায়তা গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা ঝুঁকি কমিয়ে নির্বিঘ্নে ব্রাজিলে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে পারবেন।