বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি কিভাবে করবেন: উদ্যোক্তাদের জন্য ধাপে ধাপে গাইড
মো. জয়নাল আব্দীন
প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট বাংলাদেশ (T&IB)
নির্বাহী পরিচালক, অনলাইন ট্রেনিং একাডেমি (OTA)
মহাসচিব, ব্রাজিল-বাংলাদেশ চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (BBCCI)
ভূমিকা
বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানি উদ্যোক্তাদের জন্য একটি বড় সুযোগ। এটি দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে, বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে এবং বিশ্ববাজারে স্থান করে নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে। এই নিবন্ধে আমরা একটি ধাপে ধাপে গাইড উপস্থাপন করেছি, যা ব্যবসা শুরু করার আইনগত প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে পণ্য পাঠানো, অর্থ গ্রহণ এবং সরকারি সহায়তা পর্যন্ত সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক ব্যাখ্যা করে।
১. ব্যবসা শুরু করার আইনি ও নিয়ন্ত্রক প্রক্রিয়া
রপ্তানি ব্যবসা শুরু করার জন্য প্রথমেই একটি বৈধ ব্যবসা গঠন করতে হবে। আপনি একক মালিকানা, অংশীদারিত্ব অথবা প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে আপনার প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন করতে পারেন। এটি করতে হলে আপনাকে Registrar of Joint Stock Companies and Firms (RJSC)-এর অধীনে নিবন্ধন করতে হবে, যা আপনার ব্যবসার আইনি কাঠামো নিশ্চিত করে। এরপর স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষ থেকে একটি ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হবে যা ব্যবসা পরিচালনার জন্য আবশ্যক। ব্যবসায়িক আয়কর প্রদান এবং ভ্যাট সংক্রান্ত কার্যক্রমের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR) থেকে একটি TIN (Tax Identification Number) এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে একটি BIN (Business Identification Number) সংগ্রহ করতে হবে। যদি আপনার বার্ষিক লেনদেন নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করে, তাহলে ভ্যাট নিবন্ধন বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে।
এরপর আপনাকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রধান আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের (CCI&E) দপ্তর থেকে একটি রপ্তানি নিবন্ধন সনদ (Export Registration Certificate – ERC) সংগ্রহ করতে হবে। এই সনদ ব্যতীত আপনি কোনোভাবে পণ্য রপ্তানি করতে পারবেন না। ERC সাধারণত পাঁচ বছরের জন্য বৈধ থাকে এবং তা নবায়নযোগ্য। ERC সংগ্রহের জন্য অনলাইনে OLM পোর্টালে আবেদন করতে হয় এবং প্রয়োজনীয় নথিপত্র যেমন ব্যবসা নিবন্ধন সনদ, ট্রেড লাইসেন্স, TIN, ব্যাংক সনদপত্র এবং পাসপোর্ট সাইজের ছবি জমা দিতে হয়। রপ্তানি কার্যক্রমকে আরও সহজ করতে EPB (Export Promotion Bureau) এবং DCCI (Dhaka Chamber of Commerce & Industry)-এর সদস্যপদ গ্রহণ করা হলে আপনি নানা রকমের সুবিধা ও সেবা পাবেন, যেমন ট্রেড ফেয়ারে অংশগ্রহণ ও Certificate of Origin সংগ্রহ।
২. রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় নথিপত্র ও অনুমোদন
রপ্তানি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হলে আপনাকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি সংগ্রহ করতে হবে। প্রথমেই নিশ্চিত করতে হবে যে আপনার ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স, নিবন্ধন সনদ, TIN এবং BIN রয়েছে। এরপর ERC সংগ্রহ করতে হবে যা আপনাকে রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অনুমতি প্রদান করে। যদি আপনি এমন কোনো পণ্য রপ্তানি করেন যা সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তাহলে আপনাকে অতিরিক্ত অনুমোদন যেমন ফাইটোস্যানিটারি সার্টিফিকেট (কৃষিপণ্যের জন্য), ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ছাড়পত্র (ঔষধপণ্য) অথবা প্রত্নতাত্ত্বিক বা সীমাবদ্ধ পণ্যের জন্য বিশেষ পারমিট নিতে হবে।
রপ্তানির আগে ক্রেতাকে একটি প্রোফর্মা ইনভয়েস প্রদান করতে হয় যেখানে পণ্যের পরিমাণ, মূল্য, শর্তাবলি ইত্যাদি উল্লেখ থাকে। এটি ব্যবহার করে ক্রেতা ব্যাংকের মাধ্যমে Letter of Credit (L/C) খুলে থাকে। রপ্তানির প্রতিটি চালানের জন্য ব্যাংক থেকে EXP ফর্ম সংগ্রহ করতে হয় যা বাংলাদেশ ব্যাংক রপ্তানির বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহার করে। বাণিজ্যিক ইনভয়েস, প্যাকিং লিস্ট, Certificate of Origin, বিল অব লেডিং/এয়ারওয়ে বিল, ইনস্যুরেন্স সনদ ইত্যাদি নথিপত্র কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স ও পেমেন্ট নিশ্চিত করার জন্য আবশ্যক।
৩. ধাপে ধাপে রপ্তানি প্রক্রিয়া
প্রথম ধাপে আপনাকে এমন একটি পণ্য বেছে নিতে হবে যার আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা রয়েছে এবং বাংলাদেশ থেকে প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে সরবরাহ করা সম্ভব। এরপর লক্ষ্যবস্তু দেশের আমদানি নীতিমালা ও গুণগত মান বুঝে নিতে হবে। দ্বিতীয় ধাপে ব্যবসার আইনি কাঠামো গঠন করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় সকল লাইসেন্স ও সনদ সংগ্রহ করতে হবে যেমন ERC, ট্রেড লাইসেন্স, TIN ও BIN। তৃতীয় ধাপে আপনাকে একটি রপ্তানি পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে যেখানে উৎপাদন খরচ, প্যাকেজিং, পরিবহন, ইনস্যুরেন্স, কাস্টমস খরচ ও লাভ নির্ধারণ করতে হবে। মূল্য নির্ধারণে Incoterms (FOB, CIF ইত্যাদি) অনুসরণ করতে হবে।
চতুর্থ ধাপে আন্তর্জাতিক ক্রেতা খোঁজার কাজ শুরু হয়। এজন্য EPB ও DCCI-এর সহায়তা নেওয়া যেতে পারে, অনলাইন B2B মার্কেটপ্লেস ব্যবহার করা যায় এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করা যায়। প্রাথমিক চুক্তির পরে পঞ্চম ধাপে বিক্রয় চুক্তি বা এলসি সম্পন্ন করতে হয়। এরপর ষষ্ঠ ধাপে পণ্য উৎপাদন সম্পন্ন করে সব নথিপত্র প্রস্তুত করতে হয়। এই সময়ে এলসি-তে উল্লিখিত সকল শর্তপূরণ নিশ্চিত করতে হয়। সপ্তম ধাপে পরিবহন ও লজিস্টিকস নিশ্চিত করতে হয়। একটি নির্ভরযোগ্য ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার নির্বাচন করে পণ্যের নিরাপদ পরিবহন নিশ্চিত করতে হয়। অষ্টম ধাপে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের জন্য উপযুক্ত ডকুমেন্টসহ ASYCUDA সিস্টেমে ডিক্লারেশন জমা দিতে হয়। চূড়ান্ত ধাপে, পণ্য পাঠানো হয়ে গেলে ব্যাংকে ডকুমেন্ট জমা দিয়ে পেমেন্ট গ্রহণ করতে হয় এবং সফল রপ্তানির পরে যদি কোনো সরকারি প্রণোদনা পাওয়া যায়, তার জন্য আবেদন করতে হয়।

৪. আন্তর্জাতিক ক্রেতা খোঁজার কৌশল
বিশ্ববাজারে ক্রেতা খোঁজার জন্য EPB আয়োজিত আন্তর্জাতিক ট্রেড ফেয়ার ও প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করা যেতে পারে। পাশাপাশি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম যেমন Alibaba, Tradewheel, ExportHub ইত্যাদিতে পণ্য তালিকাভুক্ত করে বিশ্বব্যাপী ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। একটি পেশাদার ওয়েবসাইট ও সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইল তৈরি করে পণ্যের বিস্তারিত তুলে ধরতে হবে। এছাড়াও EPB-এর আন্তর্জাতিক ক্রেতা ডিরেক্টরি ও ডাটাবেস, ট্রেড ম্যাপ ইত্যাদি ব্যবহার করে সম্ভাব্য আমদানিকারক চিহ্নিত করা যায়। বাংলাদেশ মিশনগুলো এবং চেম্বারগুলো অনেক সময় B2B ম্যাচমেকিং ও তথ্য সহায়তা প্রদান করে।
৫. পরিবহন ও শিপমেন্ট
চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর, যেখানে দেশের প্রায় ৯০% রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এছাড়া মোংলা বন্দর ও ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহৃত হয়। প্রতিবেশী দেশে রপ্তানির জন্য বেনাপোল স্থলবন্দর ব্যবহৃত হয়। রপ্তানির জন্য একটি বিশ্বস্ত ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার নিয়োগ করা গুরুত্বপূর্ণ যারা বুকিং, প্যাকেজিং, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স ইত্যাদির দায়িত্ব নিতে পারে। পরিবহনের আগে পণ্যের উপযুক্ত প্যাকেজিং, ইনস্যুরেন্স ও ট্র্যাকিং নিশ্চিত করতে হবে। পণ্যের গন্তব্য, ওজন ও মান অনুযায়ী উপযুক্ত পরিবহন মাধ্যম (সমুদ্র, আকাশ বা স্থল) নির্ধারণ করতে হবে।
৬. অর্থ গ্রহণ ও বিক্রয়োত্তর কার্যক্রম
পণ্য পাঠানোর পরে ব্যাংকে সকল প্রাসঙ্গিক নথি (ইনভয়েস, এলসি, বিল অব লেডিং ইত্যাদি) জমা দিয়ে পেমেন্ট নিশ্চিত করতে হয়। এলসি অনুযায়ী সব শর্ত পূরণ হলে ব্যাংক রপ্তানিকারকের অ্যাকাউন্টে অর্থ স্থানান্তর করে। টিটি বা আগাম অর্থপ্রদানের ক্ষেত্রেও প্রমাণাদি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনয়ন বাধ্যতামূলক। পেমেন্ট পাওয়ার পরে যদি পণ্যটি কোনো সরকারি প্রণোদনার আওতাভুক্ত হয়, তবে সংশ্লিষ্ট প্রমাণাদিসহ আবেদন করতে হয়। এছাড়া ক্রেতার সাথে বিক্রয়োত্তর সম্পর্ক রক্ষা ও প্রতিক্রিয়া সংগ্রহ করাও ভবিষ্যতের অর্ডার নিশ্চিত করতে সাহায্য করে।
৭. সরকারি সুবিধা ও প্রণোদনা
বাংলাদেশ সরকার রপ্তানি কার্যক্রমকে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন প্রণোদনা দিয়ে থাকে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে প্রায় ৪৩টি পণ্যের জন্য ০.৩০% থেকে ১০% পর্যন্ত নগদ প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। নির্ধারিত নিয়মে প্রমাণাদি সহ ব্যাংকের মাধ্যমে এই প্রণোদনা গ্রহণ করা যায়। রপ্তানিযোগ্য পণ্যের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক মওকুফ, কর ছাড়, ভ্যাট রেয়াত ইত্যাদি সুবিধাও পাওয়া যায়। EPZ (Export Processing Zones) ও অর্থনৈতিক অঞ্চলে কারখানা স্থাপন করলে করছাড়, অবকাঠামোগত সুবিধা ও কাস্টমস সহজীকরণ সুবিধা প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে Export Development Fund (EDF) থেকে স্বল্প সুদের ঋণও পাওয়া যায়, বিশেষত তৈরি পোশাক খাতে। EPB ও DCCI বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মশালা ও ট্রেড ফেয়ার আয়োজনের মাধ্যমে রপ্তানিকারকদের দক্ষতা ও বিপণন সক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
উপসংহার
রপ্তানি একটি সম্ভাবনাময় খাত এবং এটি উদ্যোক্তাদের আন্তর্জাতিকভাবে সফল হতে সহায়তা করে। সঠিক তথ্য, প্রস্তুতি এবং সরকারি সংস্থার সহায়তায় এই প্রক্রিয়া সহজ হয়ে যায়। এই গাইড অনুসরণ করে আপনি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে রপ্তানি শুরু করতে পারেন এবং বাংলাদেশকে বিশ্ববাজারে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে ভূমিকা রাখতে পারেন।

