২০২৬ সালে বিস্ফোরণ ঘটাবে এমন শীর্ষ ৫টি ব্যবসা ও প্রযুক্তি প্রবণতা
মো. জয়নাল আব্দীন
প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী, ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট বাংলাদেশ (T&IB)
এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, অনলাইন ট্রেনিং একাডেমি (OTA)
সেক্রেটারি জেনারেল, ব্রাজিল বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (BBCCI)
বিশ্ব অর্থনীতি আবারও এক নতুন রূপান্তরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন কাজে ঢুকে পড়েছে, জলবায়ু ঝুঁকি এখন প্রতিষ্ঠানের আর্থিক প্রতিবেদনের অংশ, আর কাজ–শিক্ষা–বিনোদনে ডিজিটাল ও বাস্তবতার সীমানা ক্রমেই মুছে যাচ্ছে। IMF এর সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৬ সালের মধ্যে বৈশ্বিক ডিজিটাল রূপান্তর ব্যয় ৩.৪ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। PwC বলছে, বিশ্ব অর্থনীতিতে AI যোগ করবে ১৫.৭ ট্রিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত মূল্য।
এই পরিবর্তনগুলো ধীরে ধীরে নয়, এক অভূতপূর্ব গতিতে ঘটছে। ২০২৬ সালে পাঁচটি শক্তিশালী ব্যবসা ও প্রযুক্তি প্রবণতা মিলিত হয়ে বৈশ্বিক বাজার, কর্মক্ষেত্র, পণ্য উদ্ভাবন ও ভোক্তা আচরণকে সম্পূর্ণ পাল্টে দেবে।
১. AI Copilot হবে কাজের প্রধান ইন্টারফেস
২০২৬ সালের মধ্যে AI Copilot অফিস, কারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল সব জায়গায় প্রধান ইন্টারফেস হিসেবে ব্যবহৃত হবে। মাইক্রোসফটের হিসাব অনুযায়ী AI Copilot চালুর পর প্রথম কয়েক মাসেই ১.৮ বিলিয়নের বেশি ইন্টারঅ্যাকশন রেকর্ড হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, AI সহায়ক ব্যবহারে প্রতিষ্ঠানগুলো ৩০–৫০% পর্যন্ত উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
AI পরিবর্তনের বাস্তব উদাহরণ:
- স্বাস্থ্যসেবা: Mayo Clinic রোগীর রিপোর্ট সারসংক্ষেপে AI ব্যবহার করে ডাক্তারদের কাগজপত্রের সময় ৪০% কমিয়েছে।
- প্রোগ্রামিং: GitHub Copilot ব্যবহারকারীদের কোড লেখার গতি ৫৫% পর্যন্ত বাড়িয়েছে।
- কাস্টমার সার্ভিস: Klarna এখন AI দিয়ে ৬৫% গ্রাহক প্রশ্নের উত্তর সম্পূর্ণভাবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দিচ্ছে।
২০২৬ সালে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনেও AI Copilot সবকিছু পরিচালনা করবে ভ্রমণ পরিকল্পনা থেকে চিঠি লেখা, পণ্যের তুলনা করা থেকে বাচ্চাদের পড়াশোনার সহায়তা পর্যন্ত।
উদ্যোক্তা সুযোগ: রপ্তানি নথিপত্র, লজিস্টিক্স, SME ফাইন্যান্স, কৃষি, স্বাস্থ্য, রিয়েল এস্টেট বা বীমা খাতের জন্য ডোমেইন-ভিত্তিক AI Copilot তৈরি যেখানে শিল্প-জ্ঞান + AI একত্রে নতুন বাজার সৃষ্টি করবে।
২. ব্যক্তিকরণ-নির্ভর অর্থনীতি (Personalization Economy) আরও শক্তিশালী হবে
Peronalization এখন সাধারণ সুপারিশ-ইঞ্জিন নয়; এটা হয়ে উঠছে রিয়েল-টাইম, আচরণভিত্তিক, সম্পূর্ণ ব্যক্তিকরণ প্রক্রিয়া। McKinsey অনুযায়ী, যারা personalization-এ দক্ষ তারা প্রতিযোগীদের তুলনায় ৪০% বেশি রাজস্ব অর্জন করে।
উদাহরণগুলো দেখলে বোঝা যায় ভবিষ্যদ্বাণী নয়, বাস্তবতা:
- Netflix ব্যক্তিকরণ কৌশলে বছরে ১ বিলিয়ন ডলার বাঁচাচ্ছে।
- Amazon–এর ৩৫% বিক্রি personalization দ্বারা।
- Duolingo–র AI প্রতিদিন ৮ কোটির বেশি ব্যবহারকারীর শেখার ধরণ অনুযায়ী পাঠ পরিবর্তন করে।
২০২৬ সালে ব্যাংক, ই-কমার্স, হেলথ অ্যাপ, শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম সবকিছুই ব্যবহারকারীর আচরণের ভিত্তিতে প্রতিমুহূর্তে কনটেন্ট ও অফার পরিবর্তন করবে। একইসঙ্গে কঠোর ডেটা প্রাইভেসি আইন বিশ্বব্যাপী কার্যকর হবে।
উদ্যোক্তা সুযোগ: SME-দের জন্য কাস্টমার ডেটা প্ল্যাটফর্ম, ছোট ই-কমার্স দোকানের জন্য AI recommendation engine, ব্যক্তিকৃত শিক্ষা/ফিটনেস অ্যাপ, এবং ডেটা-এথিকস কনসালটিং।
৩. জলবায়ু প্রযুক্তি (Climate-Tech) ও সবুজ রূপান্তর মূল ব্যবসায়িক কৌশল হয়ে উঠবে
জলবায়ু পরিবর্তন এখন CSR নয়. এটা ব্যবসার টিকে থাকার শর্ত। IEA-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৩ সালে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ১.৮ ট্রিলিয়ন ডলার। ২০২৬ সালের মধ্যে জলবায়ু প্রযুক্তির বাজার পৌঁছাবে ১.৯ ট্রিলিয়ন ডলার–এ।
বিশ্ব বদলে যাচ্ছে দ্রুত:
- গ্লোবাল EV বিক্রি ২০২৬ নাগাদ বছরে ২ কোটি ছাড়াবে।
- সোলার পাওয়ার–এর খরচ গত এক দশকে ৮৯% কমেছে।
- Unilever তাদের সাপ্লাই চেইনে ৩২% কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করেছে।
- বাংলাদেশের BGMEA–তে এখন বিশ্বের শীর্ষ ১০০ সবুজ কারখানার মধ্যে ৫৩টি অবস্থান করছে।
দৈনন্দিন জীবনে ই-ভেহিকল, স্মার্ট এনার্জি সিস্টেম, পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্যাকেজিং, প্রিসিশন এগ্রিকালচার, পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি—এসব সাধারণ হয়ে যাবে।
উদ্যোক্তা সুযোগ: কার্বন রিপোর্টিং সফটওয়্যার, SME–দের জন্য সাশ্রয়ী সোলার সলিউশন, পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্যাকেজিং, কৃষি-জল ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি, সবুজ পরামর্শ সেবা, এবং সার্কুলার ইকোনমি প্ল্যাটফর্ম।

৪. স্পেশাল কম্পিউটিং (Spatial Computing) ও ইমার্সিভ অভিজ্ঞতার বিস্ফোরণ
AR/VR/Mixed Reality মিলে তৈরি হচ্ছে Spatial Computing যা ২০২৬ সালে ব্যবসা ও ভোক্তা অভিজ্ঞতার নতুন যুগ শুরু করবে। শিল্প বিশ্লেষকদের মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে এই বাজারের আকার হবে ৬০০ বিলিয়ন ডলার।
এই রূপান্তরের বাস্তব প্রমাণ:
- Walmart VR দিয়ে ১০ লাখ কর্মীর প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, প্রশিক্ষণ সময় ৩০% কমেছে।
- BMW AR ডিজাইনে প্রোটোটাইপ তৈরি সময় ৫০% কমিয়েছে।
- IKEA Place অ্যাপ গ্রাহকদের পণ্যের সঠিক ধারণা দিতে ৯০% পর্যন্ত সঠিকতা অর্জন করেছে।
২০২৬ এ অফিস মিটিং, প্রশিক্ষণ, ডিজাইন, রিয়েল-এস্টেট ট্যুর, মিউজিয়াম ভিজিট সবই হবে ইমার্সিভ। ফোনের বদলে AR গ্লাস অনেকের দৈনন্দিন টুল হয়ে উঠবে।
উদ্যোক্তা সুযোগ: AR–ভিত্তিক শিল্প প্রশিক্ষণ, ভার্চুয়াল শোরুম, VR ক্লাসরুম, পর্যটন সাইটের ইমার্সিভ অভিজ্ঞতা, AR–সাহায্যে মেশিন মেরামত, এবং Spatial UX–ডিজাইন সেবা।
৫. স্বাধীন কাজ, ফ্রিল্যান্সিং ও মাইক্রো-উদ্যোক্তা অর্থনীতি দ্রুত বিস্তার লাভ করবে
স্বাধীন কাজের বাজার বিশ্বব্যাপী বিস্ফোরিত হচ্ছে। Statista অনুযায়ী, ২০২৭ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ৫০% কর্মীই ফ্রিল্যান্সার বা স্বাধীন পেশাজীবী হবে। Creator Economy-এর বাজার ২০২৭ সালে পৌঁছাবে ৪৮০ বিলিয়ন ডলারে।
কিছু শক্ত উদাহরণ:
- YouTube গত ৩ বছরে ক্রিয়েটরদের ৭০ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে।
- Udemy + Coursera–তে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৫ কোটির বেশি।
- Fiverr, Upwork, Toptal–এ ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা ১০ কোটির উপরে।
AI–এর কারণে একজন ব্যক্তি এখন আগে যেখানে ১০ জনের টিম লাগত, সেখানে একাই ভিডিও তৈরি, মার্কেটিং, ই-কমার্স, অনলাইন কোর্স, ব্র্যান্ডিং সব করতে পারে।
দৈনন্দিন জীবনে আরও বেশি মানুষ “মাল্টি ইনকাম স্ট্রীম” তৈরি করবে একদিকে চাকরি, অন্যদিকে অনলাইন একাডেমি, কনসাল্টিং, ফ্রিল্যান্সিং, কমিউনিটি, কোর্স, পণ্য বিক্রি।
উদ্যোক্তা সুযোগ: ফ্রিল্যান্সারদের জন্য অ্যাকাউন্টিং/ট্যাক্স সফটওয়্যার, কমিউনিটি বিল্ডিং টুল, কোর্স প্ল্যাটফর্ম, niche মার্কেটপ্লেস, AI ভিত্তিক ভিডিও/স্ক্রিপ্ট জেনারেটর, এবং আঞ্চলিক কো-ওয়ার্কিং বা ক্রিয়েটর হাব।
২০২৬: উদ্যোক্তাদের জন্য সবচেয়ে বড় সুযোগের বছর
এই পাঁচটি প্রবণতা AI Copilot, ব্যক্তিকরণ, সবুজ প্রযুক্তি, স্পেশাল কম্পিউটিং এবং স্বাধীন কাজের প্ল্যাটফর্ম একটি আরেকটিকে শক্তি দিচ্ছে। AI ব্যক্তিকরণকে চালিত করে; স্পেশাল কম্পিউটিং সবুজ শিল্পকে দক্ষ করে; স্বাধীন কর্মী এবং ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো বড় প্রতিষ্ঠানের ডিজিটাল রূপান্তর পরিচালনা করে।
উদ্যোক্তাদের জন্য মূল কাজ হচ্ছে এই প্রবণতাগুলোকে বাস্তব সমস্যার সমাধানে রূপান্তর করা। যে স্টার্টআপ সহজ, দ্রুত ও সঠিক সমাধান দিতে পারবে, তারাই দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। ২০২৬ এমন একটি বছর, যখন ভবিষ্যৎ-প্রস্তুত উদ্যোক্তারা শুধু সফলতা অর্জন করবে না, তারা গড়ে তুলবে আগামী দশকের অর্থনৈতিক কাঠামো।
সমাপনী মন্তব্য
বিশ্ব এখন এমন এক সময়ে প্রবেশ করেছে যখন প্রযুক্তি, স্থায়িত্ব এবং মানব সৃজনশীলতা অভূতপূর্ব গতিতে একত্রিত হচ্ছে। ২০২৬–এর যে প্রবণতাগুলো সামনে এসেছে, সেগুলো ভবিষ্যতের পূর্বাভাস নয়, এগুলো ইতোমধ্যেই আমাদের ব্যবসা, জীবনযাপন ও কর্মপরিকল্পনাকে বদলে দিচ্ছে। উদ্যোক্তা, নীতিনির্ধারক কিংবা পেশাজীবী যেই হোন না কেন, এখনই সময় দ্রুত মানিয়ে নেওয়ার, বিচক্ষণভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এবং সাহসীভাবে উদ্ভাবনের। যারা পরিবর্তনের ধারা আগেই বুঝতে পারবে এবং কৌশলগত উদ্যোগ নেবে, তারাই টিকে থাকবে এবং নিজেদের ক্ষেত্রের নেতৃত্ব দেবে। ভবিষ্যৎ সেই সকল মানুষের, যারা নিরন্তর শিখতে প্রস্তুত, বুদ্ধিমান প্রযুক্তিকে গ্রহণ করতে সক্ষম, দায়িত্বশীলভাবে নির্মাণে বিশ্বাসী এবং সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে। ২০২৬ শুধু আরেকটি বছর নয়, এটি একটি নতুন অর্থনৈতিক যুগের দ্বার উন্মোচনের মুহূর্ত।

